গান কে কখন কোথায় প্রথম গেয়েছিলেন কিংবা কার হৃৎ কলমে প্রথম গান রচিত হয়েছিল তা সঠিক নির্ণয় করা আজ বড় বেশি দুরূহ কাজ। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি গানের যে সুর যাকে সংগীতের প্রাণ বলা হয়, সেই সুর ভাষা জন্মেরও অনেক আগে সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ মানুষ যখন কথা বলতে শেখে নি, যখন ভাবের আদান প্রদান করতো ইশারা ইঙ্গিতে। তখন এই আদি মানুষগুলো আনন্দ উল্লাস এবং ভয় প্রকাশ করতো চিৎকার চেঁচামেচির মাধ্যমে। আর এখানেই সৃষ্টি হতো স্বর; এই স্বর থেকে সুর এবং এই স্বর থেকেই সুরের সৃষ্টি।

বিভিন্ন সঙ্গীত শাস্ত্রবিদগণ সংগীতের আদি উৎস এখানেই খুঁজে পেয়েছেন, তারা আদি মানুষের এই উচ্চারণ বা স্বর কে “নাথ” বলেছেন। আর এই নাথ থেকে স্বর, স্বর থেকেই গীত বা সংগীতের উৎপত্তি বলে মনে করেছেন।

অন্যদিকে বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণায অনুযায়ী সংগীতের সৃষ্টি বিভিন্ন জীব জন্তুর চিৎকার নকল করার প্রবণতা থেকে। চার্লস ডারউইনের মতে “বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীকে যৌনাসক্ত করার প্রচেষ্টা থেকেই সংগীতের সৃষ্টি হয়েছে।” ডারউইনের যুক্তি অমূলক নয় কারণ আমরা দেখি প্রায় প্রত্যেকটি প্রাণী যখন যৌনাসক্ত হয় একে অপরকে আকর্ষিত করার জন্য নিজেকে যথাসাধ্য সঙ্গির নিকট মোহনীয় করে তুলতে বিভিন্ন স্বরের সৃষ্টি করে এবং শারীরিক কসরতের মাধ্যমে বিশেষ ভঙ্গি প্রদর্শন করার মধ্যে একে অপরের কাছে যথাযথ উপযুক্ত করে তুলতে চায় আর মানুষ স্বভাবতই প্রকৃতিকে অনুসরণ করে। আদি হতে এখন পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন পশু পাখির স্বর নকল করে নিজের কণ্ঠে ধারণ করতে পছন্দ করি। এভাবেই হয়তো কবে কখন কার মুখে নির্গত স্বরের সঙ্গে মনের অজান্তেই ভাবময় দু’চারটা চরণ বেরিয়ে গেছে সেও হয়তো বুঝতে পারেনি। আর সেই থেকেই মানুষের কণ্ঠে জন্ম নিয়েছে সংগীত।

আবার হিন্দু শাস্ত্র মতে সংগীতে আদি রাগ ৬ টি। ছয়টি রাগের পাঁচটি রাগ শিব বা মহাদেবের মুখ থেকে নির্গত হয়েছে অপরটি জন্মেছে শিবের স্ত্রী পার্বতীর মুখ থেকে।

পাশ্চাত্য দেশে সংগীতের উৎপত্তি হিসেবে প্রচলিত আছে “জন্মের পর হোমার কিল্লেনি পর্বতের উপর গুহার পাশে একটি কচ্ছপ দেখতে পান, তিনি সেই কচ্ছপকে মেরে তাতে গরুর চামড়া ও ভেড়ার অন্ত্রে তৈরীর সাত তার দিয়ে বাদ্যযন্ত্র সৃষ্টি করেন এই বাদ্যযন্ত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়েই শুরু হয় সঙ্গীত সাধনা। এমনি বহুৎ জনশ্রুতি আছে সংগীতের উৎপত্তির ক্ষেত্রে।

বাংলা সংগীতের সৃষ্টির মূলে ধর্মীয় ভাব দর্শন থেকে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হিসাবে আমরা যে চর্যাপদকে জানি। তা ধর্মীয় ভাব দর্শনে বেশকিছু সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ এর রচিত পদাবলী। বৌদ্ধধর্মের গূঢ় অর্থ সাংকেতিক রূপের আশ্রয় ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তাঁরা পদগুলো রচনা করেছিলেন। বাংলা সাধন সংগীত শাখাটির সূত্রপাত হয়েছিল এই চর্যাপদ থেকেই। এসব সংগীত কে প্রবন্ধগীতও বলা হতো। চর্যাগীতিগুলো পটমঞ্জুরি, মাল্লারি, গুর্জরী, কামোদ, বরাবরি, গবড়া, ভৈরবী, দেশাখ, রামক্রি, অরু, শবরি, ইন্দ্রতাল, দেবক্রি, ধানশ্রী, মালসি, মালসি-গবড়ি ও বঙ্গাল রাগে পাওয়া যেত।

চর্যাগীতির পর বাংলা সংগীতে আসে নাথগীত। এই গীত প্রায় চর্যাগীতির মতই, নাথগীতির গায়ন পদ্ধতির সাথে চর্যাগীতির গায়ন পদ্ধতি বেশ অমিল ছিল। এই গীতে রাগের ব্যবহার থাকলেও গাওয়া হতো ছড়ার আকারে অর্থাৎ পাঁচালীর সুরে। পরে দ্বাদশ শতকে রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব সংস্কৃত ভাষায় মাত্রাবৃত্ত অপভ্রংশে রচিত গীতগোবিন্দম খুবই সমাদৃত হয়।

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের বাংলা সংগীতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য হলো “কীর্তন” যা এখনো বাঙ্গালীদের রস ব্যঞ্জনায় মুগ্ধ করে যাচ্ছে।

পঞ্চদশ শতকে ৪১৮ টি পথ সম্বলিত বুড়ো চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর মধ্যেই আসে মঙ্গলকাব্য হতে মঙ্গলগীত, এই গানের মূল বিষয় হলো মঙ্গল কামনা বা মঙ্গলোচ্চারণ। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা সংগীত।

হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের যখন ধর্মীয় সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরের স্তুতি প্রকাশে সাধারণের মাঝে বেশ ভাবের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচার আচরণে সংগীতের ব্যবহার করে ভাব ভক্তিতে স্বধর্মের মানুষকে নিমগ্ন করছে। সে সময় দ্বাদশ শতাব্দীতে মুসলমান সম্প্রদায়েও ভাব সঙ্গীতে এগিয়ে এলো। তখন খাজা মইনুদ্দিন চিশতী ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারেকালে মুরিদগণকে নিয়ে “সামা” নামক গান গেয়ে আল্লাহতালার প্রেমে তন্ময় হয়ে যেতেন। পরবর্তীতে মুসলিম পীর, আউলিয়া, দরবেশ ফকিরদের মাজার শরীফে আধ্যাত্মিক ধর্ম সাধনায় সঙ্গীত অনুশীলন শুরু হতে লাগলো যা এখন কিছু কিছু স্থানে প্রচলিত আছে।

এভাবেই বাংলায় স্ব স্ব ধর্মের স্তুতি প্রকাশে সংগীতের প্রসার ঘটতে থাকে।

পরবর্তীতে সংগীত ধর্মীয় বলয় পাড় হয়ে রাজা-বাদশাদের বিনোদনে রাজ প্রাসাদে চলে আসে এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির শাসনামলে মুসলিম সঙ্গীতজ্ঞরা সর্বপ্রথম ভারত উপমহাদেশিয় সংগীতকে ধর্মীয় আবরণ থেকে মুক্ত করে সাধারণের মাঝে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালায়, এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে যার নাম অনস্বীকার্য তিনি ছিলেন কবি শেখ সাদী। অন্যদিকে কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ আমির খসরু অতিমাত্রিক বৈকরণীক শাসনে নিরস ও স্থবির হয়ে থাকা নিয়ম-নীতি ও গায়ন শৈলীকে ভেঙে দিয়ে সর্বপ্রথম “খেয়াল” রীতি প্রবর্তন করেন এবং গজল রচনায় তিনি মনোযোগী হন। তিনি “কাওয়াল” নামে এক প্রকার সংগীত রচনা করেন।

এই ভাবেই সংগীত ধীরে ধীরে চলে আসে অতি সাধারণের মাঝে। কৃষক-শ্রমিক মাঝি-মাল্লাদের গলায় শুভা পেতে শুরু করে সঙ্গীত। সহজ-সরল জীবনের কথায় সুর তুলে কৃষক, আধ্যাত্মিক জগতে ডুবে সহজিয়া বাউল একতারা হাতে নাচন তুলে ভাব সংগীতে।

লোক মানসের এই আনন্দ বিরহের সুর প্রকাশের মধ্যে সৃষ্টি হয় লোকসংগীত। লোকসংগীত স্থান-কাল প্রকৃতি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন মেজাজে বিকাশ লাভ করে। বাংলার প্রকৃতি সকল অঞ্চল এক নয়, কোথাও নদীবিধৌত কোথাও অরণ্যময়, আবার কোথাও প্রস্থর ভূমি, কোথাও বা তরাই অঞ্চল। লোকসঙ্গীতের সুর সার্বজনীন হলেও এসব কারণে সুরের আবেদন সৃষ্টিতে ভিন্নতা দেখা দেয়। তাই আমরা দেখি উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া, পূর্বাঞ্চলে ভাটিয়ালি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাউল, মারফতি, জারী। অন্যদিকে পাহাড়ি অঞ্চলে নৃগোষ্ঠীদের নিজস্ব ভাষায় গারো, সাঁওতাল, ত্রিপুরা ও হাজংদের গান।

ভাওয়াইয়া সাধারণত বাংলাদেশের রংপুর, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও আসামের গোয়ালপাড়ায় প্রচলিত সেইসব অঞ্চলের গানকে বুঝায়। এই অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার কথা ভাওয়াইয়া গানে প্রকাশিত হয়।

রংপুর অঞ্চলের এই ভাওয়াইয়া গান সমগ্র বাংলা ভাষা-ভাষিদের কাছেই খুব জনপ্রিয়। শিল্পীর মধুময় কন্ঠে যখন ভেসে আসে:-

“আরে, বাওকুমটা বাতাস যেমন
ঘুরিয়া ঘুরিয়া মরে, ওরে!
ওই মতন মোর গাড়ির চাকা পন্থে
পন্থে ঘুরে রে,
ওকি গাড়িয়াল মুই চলঙ রাজপথে”

 

তখন ভাওয়াইয়া গানের কথা ও সুরের মূর্ছনায় শ্রুতার মন প্রাণ ওথলে ওঠে।

ভাটি অঞ্চলের গানকে ভাটিয়ালি গান বলে। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের এই অঞ্চলে হাওর, বাওর আর নদীর সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখের জীবন গাঁথা। এখানকার মানুষের ভাটিয়ালি গান মানুষকে নদী প্রেমিক করে তোলে, এই গানের সুর যেন অন্য এক ঋদম তৈরি করে দেয়। ভাটিয়ালি গান মনে করিয়ে দেয় বর্ষা ঋতুতে ভরা নদীর থৈ থৈ পানিতে ভেসে যাওয়া রঙ বেরঙের পাল তুলা নৌকোর কথা:

“আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে
পুবালি বাতাসে,…..
বাদাম দেইখা চাইয়া থাকি
আমার নি কেউ আসেরে……

যেদিন হতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে অভাগিনীর মনের কথা…

শত কথা ওঠে রে।।
আষাঢ় মাইসা ভাসা পানি রে…..”

পশ্চিমাঞ্চলে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, রাজশাহী, বগুড়া, জামালপুরে ছড়িয়ে আছে বাউল, মারফতি, গম্ভীরা, জারি, কবিগান, একদিল, গাজীর পালা সহ এই অঞ্চলের সুখ-দুঃখ জড়িয়ে কত কিচ্ছা পালা। এই সমস্ত গান যেন আমাদের বাংলাদেশের এক বিশাল জ্ঞান ভান্ডার, হিরা, জহরত, মুক্তোর চেয়েও বহুৎ দামি। এ যেন এক অমূল্য সম্পদের ভান্ডার। এখানে এই দেশে ১২ মাসে ১৩ পার্বণ হয়। গানে গানে আসে আমাদের ঋতু, জীবনের আনন্দ কষ্টে কণ্ঠে জড়ায় গান। এই বাংলার মানুষের প্রতিটি উৎসবেই যেন গানের সুতোয় সুনিপুণ বন্ধনে বাঁধা। গান দিয়ে যেমন বাংলার মানুষ ভালোবাসা নিবেদন করে, প্রতিবাদেও এদেশের মানুষ গানেকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।

পীছন ফিরে তাকালে আমরা দেখি স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে গান এদেশের মানুষকে কতটা সাহসী এবং সংগ্রামী করে তুলেছিলো। এদেশের মানুষ কীর্তন, পালাগান শুনে যেমন অঝোরে চোখের পানি ফেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, আবার যুদ্ধ, সংগ্রামে প্রতিবাদে গানের ভাষায় অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।

“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি,
যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা
যার নদীজল ফুলে ফুলে মোর স্বপ্ন আঁকা

যে দেশের নীল অম্বরে মন মেলছে পাখা
সারাটি জীবন যে মাটির টানে অস্ত্র ধরি”

কিংবা

“বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা
আজ জেগেছে এই জনতা এই জনতা,
তোমার গুলি, তোমার ফাঁসি,
তোমার কারাগারের পেষণ
শুধবে তারা ওজনে তা
এই জনতা এই জনতা

তোমার সভায় আমির যারা
ফাঁসির কাঠে ঝুঁলবে তারা
তোমার রাজা মহারাজা
করজোড়ে মাগবে বিচার
ঠিক যেন তা, এই জনতা”

এই সমস্ত সংগ্রামী সংগীত এখনো বাংলার মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সাহসি এবং আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। তাই আমরা কৃতজ্ঞ আমাদের সকল শ্রেণি পেশাজীবীদের কণ্ঠ থেকে ওঠে আসা সমস্ত বাংলা সংগীতের প্রতি। বাংলা সংগীত প্রবহমান নদীর মতো বয়ে চলুক, প্রকৃতির মতো চির সবুজ হয়ে আমাদের হৃৎস্পন্দনে দিয়ে যাক সজীবতা।