কবিতা আসলে এক খণ্ড যন্ত্রণা, চৈতন্য হতে যা মানুষের মস্তিষ্কে জন্ম নেয়। এই যন্ত্রণাকে যিনি সময় মিলিয়ে প্রসব করতে জানেন তিনিই কবি। একজন কবির দেখবার চোখ থাকে তিনটি, অন্য সবার মতো দু’চোখে তিনি আকাশ, নদী, ফুল-পাখি দেখেন আর তৃতীয় চোখে তিনি দেখেন প্রাণের ভেতর আরেকটা প্রাণ। দেখেন অন্ধকারে মৃত নক্ষত্র থেকে নেমে আসা মশাল হাতে অসংখ্য নিপীড়িত মানুষের মিছিলকে। ঝরা পাতার ছটফটানি একজন কবিই শুধু দেখেন তার তৃতীয় চোখে।

যাপিত জীবনের আড়ালে কবির আরেকটা জগৎ আছে ক্ষুধা আর মান-অপমানের যন্ত্রণা থেকে একেবারেই আলাদা। যেখানে কবি তৈরি করেন ঘোর, আত্ম মগ্নতা, সেখানে কবি একজন মহাসন্ন্যাসী, একজন দাতা, ত্রাণকর্তা, উজার করে দিতে থাকেন জগতকে, তখন ঈশ্বরের জ্যোতির্ময়তায় তিনি উদ্ভাসিত হন আর ধীরে ধীরে একজন কবি হয়ে ওঠেন আত্ম বলিয়ানে এক আলোক বর্তীকা।

কবি সৌহার্য্য ওসমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “জলঘুমে অথরা” বইটি পড়েছি আবার পড়লাম, এবার অনুভবের জায়গা থেকে অথরার মাঝে ধ্যানমগ্ন হবার প্রয়াস রেখেছি। তাই ভাবলাম ভেতরের ভাবনাগুলোকে খানিক সামনে আনা যায় কিনা- শুধুই আমার মতো করে সাধারণ একজন পাঠকের ভাবনা থেকে।

‘অথরা’ কবির চৈতন্য; কোন নারী নয়, ‘জলঘুমে অথরা’ প্রেমের কাব্যগ্রন্থও নয়। তন্দ্রাচ্ছন্ন কবির আত্মচৈতন্য প্রকাশ পেয়েছে যাকে তিনি জাগিয়ে তুলতে চান নাগরিক জীবনের দ্রোহ আর ভালোবাসায়। তিনি কাব্যগ্রন্থটি জুড়েই অথরার বন্ধনা করে গেছেন বিভিন্ন সুরে বিভিন্ন ব্যাঞ্জনায়। ভিন্ন ভিন্ন চিত্রকল্পে অথরাকে এঁকেছেন শিল্পীর নিখাঁদ তুলির আঁচড়ে। মোহময় এক ভালোবাসায় কবি বাড়িয়েছেন হাত তার অথরার দিকে-

“অথরা ভাজ খোলো ওম দাও
দু’হাত পাতা হাতে”।

“অথরা তোমার বসন্তের আকাশটা দেখছি-
প্রতিদিনের ঝরা পাতা ধূলির সাথে উড়ে উড়ে পাখি হয়।”

কবি যখন অভিমানী হয়ে ওঠেন অথরার মাঝে তখন দেখি ভিন্ন রূপ-

“অথরার মেহেদি শুকানোর আগেই
ভেসে যায় স্বামীর রাজহংস”

“যখন নাক ফুল পরেও কবুল বলেনি অথরা”
“কী হবে পৌরুষের তুমি কি জানো অথরা?

আবার কখনও কখনও অথরার মাঝে দ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠতে দেখি,তখন কবি অথরার মাঝেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন-

“অথরা তোমার স্পর্শে স্পর্শে ফুটুক
পোড়া চাঁদ, পোড়া ঘর
পোড়া গোয়ালের সব ক’টি গরু”

“জেগে থাকা বুকের ক্যানভাসে অথরার খোলা চিঠি-
বাতিল নয়, কোটা সংস্কার চাই”

এই কাব্যগ্রন্থে অথরা যেন বহতা এক অলকনন্দা, কিংবা কানো ক্রিসটেলস, গুপ্তধন সমৃদ্ধ এক রংধনু নদী যার বাঁকে বাঁকে বৈচিত্রময়তা ফুটে রয়েছে।

‘জলঘুমে অথরা’ কাব্যগ্রন্থটি মলাট আলোচনার পর পাঠকদের নিয়ে যেতে চাই ভেতরে, যেখানে অপেক্ষা করছে কাব্যের নান্দনিকতা। কাব্যগ্রন্থটি কবির যদিও প্রথম প্রয়াস কিন্তু বিষয়বস্তু নির্বাচন, উপমা, চিত্রকল্প ও দৃশ্যময়তা উপস্থাপনে ঠিক সিদ্ধ হস্তেই বুননে সমৃদ্ধ একটি কাব্য।যেখানে নাগরিক জীবনের অপ্রাপ্তির দ্বন্দ্ব প্রধান রূপে প্রকাশ ঘটেছে।

জল ভরা গ্লাস, পড়ার টেবিল
বালিশের পাশে রিমোট কন্ট্রোল চাপা
আকাশ বিজ্ঞান,
গোপনে তারার সাথে মিতালি করা নিয়ন আলোর স্ট্রিট লাইট
মেইন রোডে লম্পট শিকারির ভেজা হাত
সাদা ছড়ির আলোহীন অপাপ মেয়ে
তারও পায়ে মিশে থাকে দুধ কুয়াশার চাদর

দেয়াল

কবি তার কাব্যগ্রন্থে নাগরিক জীবনের এক অন্তঃসারশূন্য সভ্যতার কথা ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতায় বারবার মুচড়ে উঠেছে এক অপূরণীয় যন্ত্রণা। আমরা দেখছি পৃথিবীর আদি প্রাণ মৃত্তিকার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধ্বংস স্তুপের পীঠে গড়ে ওঠেছে নগর সভ্যতা। উন্নয়নের চিমনি উগড়ে দিচ্ছে বিষ, তখন কবি করেছেন বৃক্ষের বন্দনা-

সহজাত ভাবে পাঠ নেব আজ গাছের কাছে
সবুজের সাথে পাতায় পাতায় পাতাদের কথা…
গাছপাড়ায় বাতাসের গন্ধের আনাগোনা চেনা থাকে
দূর হতে আসে তবু প্রতিবেশী আচরণ কমেনি ঝড়ে
সুদূর দূরত্বে ঘর ফেলে জেগে থাকে, তখন
নিঃশ্বাস দূরত্ব কেবলি খেলনা জাগে
গাছ বেঁচে থাকে অথরার ঠোঁটে

গাছ

কবির চৈতন্য ‘অথরা’ এখানে এক বৃক্ষমানবি হয়ে জেগে ওঠেছে। তাই তার বন্দনার এ আহুতি।

গেলাসের জলে থাকা লালের ভেতরের লাল
সময়ের সাথে ভেঙে গেলে
রাজপথ মুনিরা’রা কেড়ে নেয়
নির্মাণ করে সময়ের অলিগলি
তখন সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক তোমার নামে
অথরা শুধু তোমারই নামে হয় একখণ্ড রামপাল।

বালক সময়

একজন প্রকৃত কবি সময়কে ধারণ করেন, সম সাময়িক ঘটে যাওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ইস্যুকেই তিনি তার কবিতায় উঠিয়ে আনেন। বাংলাদেশের রামপাল ও কোটা আন্দোলন কবির চৈতন্যে দাগ কাটে। এ সময়ে তিনি শান্তিতে নোবেল পাওয়া ওয়াং সাং সুচিকে রাখাইন হত্যায় দায়ী করে তীব্র ঘৃণা ছুঁড়ে দিতে এতটুকুন দ্বিধা করেননি। তিনি

“রাখাইন রাত” কবিতায় লিখেছেন-

রাতে ঘুম আসে না
তবে কেউ কি আছে, কবজের দাওয়া নিয়ে
পিশাচ সুচিকে ছিঁড়ে খাবে
রক্ত ছোবল দেবে দরজায়?

আবার দেখি রাষ্ট্রের আরও একটি বড় ইস্যু কোটা সংস্কার আন্দোলনে তিনি কবিতাকে হাতিয়ার করে আন্দোলনকারীর সাথে একাত্ম হয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন-

সামনে প্রসারিত শক্ত হাত- বুলেটপ্রুফ বুকের জমিন
পতাকার লালে- সব আজ কৃষ্ণচূড়া ফুল
জেগে থাকা বুকের ক্যানভাসে অথরার খোলা চিঠি-
বাতিল নয়, কোটা সংস্কার চাই

সম-সাময়িক বেশ ক’টি আন্দোলনেই কবি নিপীড়িত মানুষের পাশে তার কবিতাকে দাঁড় করিয়েছেন এ কাব্যগ্রন্থে।

ডালিম ফেটে যাওয়ার মতন জীবন যাপন
কেমনে আটকে ধরে থাকে এক শীতকাল
এ হাওয়া চুইংগাম; লেগে থাকে
ঠাডাকুড়ায় সারাক্ষণ, এমন নদীর কুলে যার হাল
পথে পথে ফুল আর কত দীর্ঘায়ন!
তবু কাসাভার পাতা মোড়ানো সবুজ
অন্ধ বিক্রেতা দিন শেষে নিয়ে যায়
নালিখালি

কবি তার এ কাব্যগ্রন্থে অযথা বিরহ, ছিছকে কান্নার ভান কবিতায় আনেননি। তিনি স্বাভাবিক ঝর্ণা ধারার চটুল গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেছেন কবিতার ধারাকে। আমরা দেখি তার কবিতায় হৃদয়াবেক প্রাধান্য পায়নি, পেয়েছে হৃদয় দহন, নাগরিক জীবনের অপ্রাপ্তির দ্বন্দ্ব ও হৃদয়মথিত অনুভব। কবি তার জলঘুমে অথরায় যাপিত জীবনে সময়ের পাশাপাশি তিনি স্থানকেও প্রাধান্য দিয়েছেন, তাইতো তার কবিতায় নালিখালি, ঠাডাকুড়া, নতুন বাজার, ঢলুয়াবিলের মত জায়গাও ঠাঁই করে নিয়েছে। অন্যদিকে জলঘুমে অথরা কাব্যগ্রন্থটি কোথাও যে ছন্দপতন ঘটেনি তেমনটি একেবারেই বলা যাবে না, যেমনটি তার কাব্যগ্রন্থে কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ভাবের ছন্দপতন ঘটেছে তা পরবর্তি কাব্যগ্রন্থগুলোতে তিনি আরও সর্তক থাকবেন।

আরেকটি বিষয়ে না বললেই নয় কবি তার অধিকাংশ কবিতায়েই অথরাকে অযথাই ব্যবহারের একটা প্রয়াস ঘটিয়েছেন, যাতে একজন পাঠকের মস্তিষ্কে অনাকাঙ্খিত বিরক্তির তিক্ত ভাব অনায়াসেই আসতে পারে আর এতে পাঠকের ভাবাবেগেও কিছুটা বিঘ্ন ঘটতে পারে। আশা করি পরবর্তীতে আরও ঘোর আরও হৃদয়মথিত অনুভবের জায়গায় কবি সৌহার্য্য ওসমানকে আমরা দেখতে পাবো। তবে সর্বোপরি পাঠক জলঘুমে অথরা কাব্যগ্রন্থটি পড়ে মধ্যবিত্ত একটি জীবন ধারাকে খুঁজে পাবেন, একটা সময়ের ভেতর দিয়ে পথ হেঁটে পরিশুদ্ধ জীবনের ভাবাবেগ নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর নিশ্চয়ই তুলবেন।