কে কবে কোথায় ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমী স্নান শুরু করেছিলো বলা না গেলেও আবহমান বাংলায় বহু আগে থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অষ্টমী স্নান তিথি পালন করে আসছে।
অষ্টমী স্নান এর ইতিহাস
চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের অষ্টমী তিথিতে ব্রহ্মপুত্র হয়ে ওঠে পাপ হরণকারী মহাপূণ্য এক জলধারায়। এই বিশ্বাসে সনাতনীরা তাদের পাপ মুছনের জন্য স্নানে যোগ দেয়।
যেহেতু এই তিথিতে ব্রহ্মপুত্র স্বয়ং জাগ্রত হয়ে মর্তলোকের পূণ্য প্রার্থীগণের পাপ হরণ করে নেন। সেই বিশ্বাসে ভক্তগণ তাদের জাগতিক পাপ মুছনের পাশাপাশি মনোবাসনা পুরনের জন্য নদের জলে মানত করে থাকেন। দেবতা তুষ্টির আশায়, ডাব, কলা, জোড়া কবুতর, ফুলপাঠা ইত্যাদি জলে ভাসিয়ে দেয়।
ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বাইগনবাড়ি (বেগুনবাড়ি) ঘাটে এই দিনে হাজার হাজার পূণ্যার্থী ভোরের আলো ফোটার আগেই এসে হাজির হন। ক্রমেই বাড়তে থাকে মানুষের ঢল।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে স্নান ঘাটে তিল ধারনের জায়গা টুকু থাকেনা। বহু দূর থেকে বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজও, অটো, রিক্সা, ভেন ভাড়া করে এখানে আসেন স্নান করতে। ময়মনসিংহ সদর, টাঙ্গাইল, শেরপুর জেলার মানুষও এখানে আসেন স্নানের জন্য।
ধর্মের লৌকিকতা পালনে চিরকালই বাঙালি মহিলারাই পুরুষদের থেকে এগিয়ে। অষ্টমী স্নানেও তার ব্যাতিক্রম নেই। এখানে প্রতি বছরই পুরুষদের থেকে মহিলা’ সনাতনীদের উপস্থিতি বহুগুণে বেশী। কিশোর-কিশোরীর উপস্থিতি যথেষ্ট থাকলেও তরুণদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো নয়, একেবারেই নগন্য।
নবদম্পতি এখানে পুণ্য লাভের পাশাপাশি মনোবাসনা পূরণের আশায় আসেন। তারা দাম্পত্ত জীবন সুখী হওয়ার ব্রত নিয়ে নদের জলে জোড়া কবুতর মানত সহ বিভিন্ন লোকাচার পালন করেন।
এখানে স্নান ক্রিয়া সম্পাদনে দু চার-পাঁচজন ঠাকুরও উপস্থিত থাকেন। পুণ্যার্থীদের লোকাচারে সহযোগিতা এবং মন্ত্র পাঠ করে তাদের সহযোগিতা করে থাকেন। এর জন্য ভক্তগণ ঠাকুরকে প্রণামি দেয়ার প্রচলনও আছে।
অষ্টমী স্নান এর মন্ত্রটি হলো-
ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতী
নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেহস্মিন সন্নিধিং
করু পরে কৃতাঞ্জলি হয়ে- ওঁ করুক্ষেত্র গয়
গঙ্গা প্রভাস পুদ্ধারিণী চ।
তীর্থান্যেতানি পুন্যানি স্নানকালে ভবন্ত্বিহ।
ব্রহ্মপুত্র স্নানের একটি পৌরানিক কাহিনী আছে। কিভাবে এই স্নান চৈত্র মাসের অষ্টম তিথিতে পড়লো আর কেনই ব্রহ্মপুত্র নদের জলেই এই স্নান ক্রিয়া সংগঠিত হয়।
মহামুনি জমদগ্নির পরমা সুন্দরী স্ত্রী রেনুকা, মার্তিকাবর্ত দেশের রাজা তার স্ত্রীর সাথে জলবিহার করতে দেখে তার কাম স্পৃহার উদ্বেগ হয়। যেহেতু তিনিও একজন রাজকন্যা, তাই তার এই ভাব উদ্বেগ হয় আমার বিয়ে যদি এই রাজার সঙ্গে হতো আমিও এমন জলকেলিতে নিমগ্ন হতাম। মহামুনি তার সাধনা বলে স্ত্রীর কাম স্পৃহা টের পেয়ে স্ত্রী রেনুকার উপর ভীষণ ক্ষুদ্ধ হন। পরে তার পাঁচ পুত্রকে তাদের মাকে হত্যার আদেশ দিলেও মাতৃ হত্যার মতো নিষ্ঠুর এবং গরহিত কাজ করতে সকলেই অসম্মতি জানায়। মহামনি এতে আরও ক্রদ্ধ হয়ে পড়েন।
অবশেষে কনিষ্ঠ পুত্র পরশু রামকে ডেকে পৃত্রাদেশ পালনে বাধ্য করেন। পরে পরশু রাম তার কুঠারের আঘাতে মাকে হত্যা করে পিতার আদেশ পালন করেন। মহামুনি জমদগ্নি খুশি হয়ে পরশু রামকে বর চাইতে বললে এই সুযোগে সে তার মার পুনর্জীবন প্রার্থনা করেন। মহামুনি খুশি হয়ে স্ত্রী রেনুকাকে আবারও জীবন দান করেন।
কিন্তু পরশু রামের হাত থেকে কোন মতেই কুঠার ছাড়াতে পারছিলো না। পরশুরাম এই ঘটনা বাবাকে জানালে মহামুনি তাকে জানান, মাতৃ হত্যার মতো জঘন্য পাপের পরিণতির জন্যই তার এরূপ হয়েছে।
পরশু রাম তার এই প্রাশ্চিত্ত কিভাবে হবে জানতে চাইলে তার বাবা তাকে বালেছিলো, “পুত্র মানস সরবরে যাও, দেবতা ব্রহ্মপুত্র হিমালয়ের বুকে হৃদ রূপে লুকিয়ে আছেন। তুমি পৃথিবীর পীঠস্থান ভ্রমণ করে সেই পবিত্র জলে স্নান করলেই এই কঠিন পাপ থেকে মুক্তি লাভ করবে। আর তখনই তোমার হাতে আটকে থাকা অভিশপ্ত কুঠার খসে পড়বে।”
পরশু রাম এই শুনে, দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে একদিন মানস সরবরে এসে পৌছলো এবং ব্রহ্মপুত্র রূপি সেই সরবরে স্নান করে তার পাপ মুছন করলেন ।
সেই দিনটি ছিল চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের অষ্টমী তিথি।
ব্রহ্মপুত্রের এই অলৌকির শক্তি দেখে তিনি সাধারণের উপকারে আসবে বলে এই পাপ হরণকারী জলধারাকে সমতলে নিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায় প্রকাশ করলেন। পরে পরশুরাম লাঙলের ফলা দ্বারা নালা টেনে মানুষের উপকারের জন্য এই লোকালয়ে নিয়ে আসেন বলে পৌরানিক গাঁথায় শোনা যায়।
পরশু রাম যেখানে লাঙল থামিয়ে কিছু নিমেশ জিরিয়ে ছিলেন সেখানেই স্নান ঘাট প্রতিয়মান হয়েছে। ময়মনসিংহের বাইগন বাড়ি ঘাটে তিনি জিরিয়েছেন বলেই এটি এখন পুন্যস্থান হিসেবে খ্যাত। পরশু রাম নালা টেনে টেনে নারায়ণগঞ্জে লাঙল বন্দ স্থানে এসে তার লাঙল আর চলছিলো না, লাঙল বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সেই স্থানটি তাই লাঙল বন্দ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।
বাইগন বাড়ি অষ্টমী স্নানকে কেন্দ্র করে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে, প্রতি বছরই বিশাল মেলা বসে। এখানে বাচ্চাদের খেলানা থেকে শুরু করে হলুদ, মরিচ, গৃহস্থালির সব জিনিস পত্র পাওয়া যায়। বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য তরমুজ, খুড়মা, চিনির খাচ, মিষ্টি দই, ঝুরি এইসব খাবারের প্রসরা সাজিয়ে বিস্তর জায়গা জুড়ে বসে মেলা।